
| Headline : |
|
মুন্সীগঞ্জে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস জড়িয়ে আছে যার নামে-
প্রথম শহীদ বাবা আদমের ৫৪২ বছরের পুরনো দরগা মসজিদ
বার্তা প্রেরক : রোকাইয়া জামান লাবনী, বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকা।
|
|
দৈনিক শিক্ষাতথ্য, ঢাকা (১৩ জুলাই, ২০২৫) :-
একজন হজযাত্রীর মুখে বিক্রমপুরের রামপালে মুসলিমদের ওপর রাজা বল্লাল সেনের নির্যাতনের কাহিনি শুনে অত্যাচার বন্ধ ও ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে সুদূর আরব থেকে রামপালে আসেন বাবা আদম। এটি ১১৭৮ সালের কথা। তখন বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জে ছিল বল্লাল সেনের রাজত্ব। ওই বছরই (১১৭৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর) এক যুদ্ধে বল্লাল সেনের হাতে প্রাণ দিতে হয় তাকে। বাবা আদমকে মিরকাদিমের দরগাহবাড়িতে দাফনের পর তার মাজারের পাশে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহর শাসনামলে মালিক কাফুর ৮৮৮ হিজরিতে (১৪৮৩ খ্রি.) নির্মাণ করেছিলেন একটি মসজিদ। এটি ছিল তার মৃত্যুর ৩০৫ বছর পর। সেই থেকে প্রায় ৫৪২ বছর ধরে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে মসজিদটি। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ স্থাপনার তত্ত্বাবধান করছে। তৎকালীন ভারতবর্ষে যে কয়টি প্রাচীন মসজিদ ছিল, সেগুলোর মধ্যে একটি বাবা আদম মসজিদ। মসজিদটি এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ![]() প্রথম শহীদ বাবা আদমের ৫৪২ বছরের পুরনো দরগা মসজিদ কথিত আছে, বিক্রমপুরের মহাপরাক্রমশালী রাজা বল্লাল সেন গরু জবাই ও আজান দিয়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করেছিলেন। রামপালের নিকটস্থ আব্দুল্লাহপুর গ্রামের কানাইচং মাঠের জনৈক মুসলমান তার ছেলের জন্ম উপলক্ষ্যে অতি গোপনে গরু জবাই করেন। কিন্তু একটি চিল ছোঁ মেরে এক টুকরো মাংস নিয়ে বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদের আঙ্গিনায় ফেলে। বল্লাল সেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে গো হন্তারককে খুঁজে বের করতে গুপ্তচর নিয়োগ করেন। বল্লালের নির্যাতনের ভয়ে গরু জবাইকারী ব্যক্তি বিক্রমপুর থেকে পালিয়ে গিয়ে সুদূর মক্কায় হাজির হন। তখন মক্কায় বাবা আদম নামক এক জবরদস্ত ফকির ছিলেন। উক্ত ব্যক্তি বল্লালী নির্যাতনের প্রতিকারের জন্য বাবা আদমের শরণাপন্ন হন। বল্লাল কর্তৃক মুসলিম নির্যাতনের কাহিনি দরবেশকে আদ্যোপান্ত বলেন। বিক্রমপুরে বল্লাল রাজার অধীনতা থেকে তাদের উদ্ধার করবেন-এই উদ্দেশ্যে তিনি তার মুরিদদের দ্বারা গঠিত একটি সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি মক্কা থেকে বাংলাদেশের বিক্রমপুর অভিমুখে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করেন। তিনি এবং তার সৈন্যবাহিনী বল্লাল রাজার রাজধানী রামপালের উপকণ্ঠে দরগাবাড়িতে এসে ঘাঁটি গাড়েন। বাবা আদম ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান প্রকাশ্যেই পালন করা শুরু করেন। আজান দিয়ে নামাজ পড়া শুরু হয়। রাজধানী রামপালের মাইল দুই দূরবর্তী কানাইচঙ্গের মাঠে প্রত্যুষ থেকে তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বল্লাল সেন বাবা আদমকে হত্যা করেন। পরবর্তীতে নানা ঘটনা পরম্পরায় রাজা বল্লাল সেন অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেন। এরপর বিক্রমপুর মুসলমানদের করতলগত হয়। শহীদ দরবেশ বাবা আদমকে সমাহিত করা হলো তার নির্মিত মসজিদের গজ কয়েক পূর্বে। তখন থেকেই মসজিদটির নাম হলো বাবা আদমের মসজিদ আর সমাধিটির নাম হলো বাবা আদমের দরগা। বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুর-মুন্সীগঞ্জ এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন স্থানটি মুসলিম শাসকদের নিয়ন্ত্রণে আসার অনেক আগে; ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে। সে সময় বাবা আদম ছিলেন একজন সুফি সাধক। ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত শহর তায়েফে ১০৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ১২ জন আউলিয়া নিয়ে মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমের দরগাবাড়ি এলাকায় আসেন তিনি। মুন্সীগঞ্জ এলাকার কপালদুয়ার, মানিকেশ্বর ও ধীপুরে তিনটি খানকাহ নির্মাণ করে তিনি ইসলাম প্রচার করেন। বাবা আদম শহীদ হওয়ার প্রায় ৩০০ বছর পর তার স্মৃতি রক্ষার্থে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন আবু জাফর শাহের পুত্র বিক্রমপুরের শাসক মহান মালিক কাফুর শাহ্ ছয় গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করেন। তার মাজারের পশ্চিম-উত্তর পাশে ১৪৭৯ সালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৪৮৩ সালে নির্মাণ শেষ হয়। সেই থেকে সাড়ে ৫শ বছর ধরে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে এই মসজিদটি। তবে সংস্কারের অভাবে অনেকটাই ম্লান স্থাপনাটি। মসজিদের সামনে লাগানো একটি আরবি শিলালিপি অনুযায়ী, জালালুদ্দিন ফাতেহ শাহের আমলে মালিক কাফুর ৮৮৮ হিজরিতে (১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে) নির্মাণ করেছিলেন মসজিদটি। সরেজমিন দেখা গেছে, ছয় গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদের নির্মাণশৈলী মনোমুগ্ধকর। এটি দৈর্ঘ্যে ৪৩ ফুট ও প্রস্থে ৩৬ ফুট। দেয়াল প্রায় চার ফুট চওড়া। ইট-সুরকি দিয়ে ভেতরে গাঁথা। মসজিদটি নির্মাণের সময় ১০ ইঞ্চি, ৭ ইঞ্চি, ৬ ইঞ্চি ও ৫ ইঞ্চি মাপের লাল পোড়ামাটির ইট ব্যবহার করা হয়েছে। নির্মাণ নকশা বা স্থাপত্যকলা অনুযায়ী মসজিদ ভবন উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। পশ্চিম দেয়ালে তিনটি অলংকৃত মেহেরাব আছে। সামনের দিকে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ। দুই পাশে সম আকারের দুটি জানালা। মসজিদের সামনে ওপরের দিকে রয়েছে ফারসি ভাষায় খোদাই করা কালো পাথরের ফলক। এ ছাড়া ভেতরে ঢুকে সামনে এগোলে চার কোনায় চারটি ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভ চোখে পড়ে। মসজিদের চারকোণে ৪টি টরেট রয়েছে, যা অষ্টাভুজাকৃতির। চমৎকার কারুকার্যখচিত এই মসজিদটির ছাদে ৬টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের খিলান, দরজা, স্তম্ভের পাদদেশ, মেঝে ও ছাদের কার্নিশের নিচে ইট কেটে মুসলিম স্থাপত্যকলার অপূর্ব নকশাও লক্ষ করা যায়। ভারতবর্ষ প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ ১৯০৯ সালে একবার এ মসজিদটি সংস্কার করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এরপর আর কোনো কাজ হয়নি। ১৯৯১ সালে লোহার সীমানা বেড়া দেয় বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত অধিদপ্তর। জনপ্রিয় মাধ্যমে উপস্থাপনা : ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বাবা আদম মসজিদের ছবি সংবলিত একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। |